Friday, December 8, 2017

প্রবাসে দৈবের বসে

প্রবাসে দৈবের বসে শান্তনু সরস্বতী নীরোদচন্দ্র চৌধুরির সঙ্গে সহমত নই আমি। প্রয়াত লেখক তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ-- "আত্মঘাতী বাঙালি"-তে লিখেছিলেন, "এ কালের বাঙালিজাতির জন্মগত বিশ্বাস--বাঙালি হইব কিন্তু মানুষ হইব না।" প্রখ্যাত সাহিত্যিক নীরোদচন্দ্র চৌধুরির কথাই যদি অমূল্য বচন হয়, তা হলে অশোক সেন, আশিস নন্দী, অমলকুমার রায়চৌধুরি, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, কৌশিক বসু, মীর মাসুম আলি, দেবরাজ রায়, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য--রা কি তাহলে বাঙালি নন ? না কি বাঙালি সেই ফুল যা কি না শুধুমাত্র বিদেশের মাটিতে, বিদেশের আলো-হাওয়া-বাতাসেই বেড়ে ওঠে। দেশে তাঁদের প্রতিভার কোনও স্বীকৃতি নেই ? বলা হয়, বাঙালি না কি পঞ্জাবি বা গুজরাতিদের মতো একেবারেই নয়। আজন্ম দেশে নিজের জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতেই বেশি ভালবাসে। যে সব বাঙালির মাথায় বিশ্ব সেরার তকমা উঠেছে, তাঁরা না কি সকলেই কোনও না কোনও সময় বিশ্ব সফর করেছেন। যেমন স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমৃতাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অমর্ত্য সেন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, কিংবা পদার্থ বিজ্ঞানী অশোক সেন কিংবা লেসার রস্মীর স্রষ্টা মণি ভৌমিক। জীবনের বেশ কয়েকটি বছর এঁরা প্রত্যেকেই কাটিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। প্রথম বিশ্বের কোনও দেশে। প্রবাসে কোনও এক সময় তাঁদের কীর্তি-ই নাকি এনে দিয়েছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। স্বামী বিবেকানন্দ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের কৃতি বাঙালি পদার্থ বিজ্ঞানী অশোক সেন। সকলেই প্রবাসে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময় । অমর্ত্য সেন তো বহু বছর ধরেই প্রবাসী । কিন্তু মাইকেল মধুসূদন দত্ত? তাঁকে তো লিখতে হয়েছিল --" প্রবাসে দৈবের বসে জীবতারা যদি খসে, এদেহ আকাশ হতে নাহি খেদ তবে, জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে, সাধিতে মনের সাধ, ঘটে যদি পরমাদ, মধূহীন করো না গো তব মন কোকোনদে।" তাই আবার নীরোদচন্দ্রের কথাতেই ফেরা যাক। তাঁর কথার প্রেক্ষিতেই হোক না এই লেখার বিষয়-- আননোন বেঙ্গলিজ বা যাঁদের নিয়ে এখনও অবধি খুব কমই খরচ হয়েছে নিউজপ্রিন্ট। এই বাঙালিরা কেউ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত বা বাবু সম্প্রদায়ভুক্ত নন, যাঁরা রূপে কার্তিকেয় কনিষ্ঠ, গুণে বিশ্বকর্মাপুত্র। এঁরা কৃতী বাঙালি, যাঁরা শুধু বাঙালির একান্ত ভালবাসার জাতিসত্ত্বাকেই নয়, বাড়িয়ে তুলেছেন বিশ্বসমাজে দেশের সম্মান। 1956 সালে এই শহর কলকাতাতেই জন্ম, অশোক সেন স্টোনিব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট । ফার্মিল্যাব ও স্টানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলেটর সেন্টারে একজন বিজ্ঞানী-গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে প্রথমে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ এবং পরে হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন অশোক সেন। বলা হয়, পদার্থ বিজ্ঞানে স্ট্রিং থিওরি নিয়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যেখানে শেষ করেছিলেন, অশোক সেন সেখানে শুরু করেছেন তাঁর গবেষণা। এর মধ্যে স্ট্রং-উইক কপলিং ডুয়ালিটি অথবা এস ডুয়ালিটি নিয়ে অশোকবাবুর গবেষণা সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছে বহু বছর আগেই। অপ্রকৃতিস্থ ডি-ব্রেন এবং তার ওপর ওপেন স্ট্রিং ট্যাকিওন সংক্ষেপনের প্রভাব বা তরল অংশ বাদ দিয়ে বিভিন্ন যৌগিকের দুই বা একাধিক পরমাণুর মিলন নিয়ে অশোকবাবুর গবেষণা একরকম পথিকৃত। তাঁর এই স্মরণীয় কাজের জন্য প্রথমে 1989 সালে আইসিটিপি সম্মান, 1994 সালে এস এস ভাটনগর সম্মান এবং পরিশেষে 2001 সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন তিনি। 23 এপ্রিল 2007 সালে আউটলুক ম্যাগাজিনের 25 জন প্রখ্যাত ভারতীয়র একজন অশোক সেন, যিনি কখনও দেশের শাসন ক্ষমতার তালিকায় না থেকেও সমাজকল্যাণে অবদান রেখেছেন। প্রণম্য এই পদার্থ বিজ্ঞানী সম্পর্কে তাই বলা যেতেই পারে, রাজা নিজ রাজ্যে পূজিত, কিন্তু বিদ্যান পূজিত সর্বত্র। পদার্থ বিজ্ঞানী অশোক সেনের মতোই অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর জন্ম এই কলকাতা শহরে। একটা সময় ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের প্রধান উপদেষ্টা এবং কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সি-মার্ক অধ্যাপক কৌশিকবাবুর পড়াশোনা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। পরবর্তীতে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজের স্নাতক কৌশিকবাবু চলে গিয়েছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে। তারপর অর্থনীতিতে ডক্টরেটও ওই লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকেই। কর্মজীবনে বহু বছর তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটি, ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব প্রিন্সটন, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কোর এবং ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত থাকার পর 1992 সালে দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিক্সে সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স স্থাপন করেন। কৌশিকবাবুই ওই প্রতিষ্ঠানের প্রথম এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। ইকোনোমেট্রিক সোসাইটির ফেলো কৌশিকবাবুকে তাঁর শিশু শ্রমিক, শিল্প সংস্থা, গেম থিওরি এবং উন্নয়নমূলক অর্থনীতির ওপর প্রকাশিত গবেষণাপত্রের জন্য তদানীন্তন ভারত সরকার মহালনবিশ স্মৃতি সম্মান প্রদান করে। আর 2008 সালে সম্মানিত হন পদ্মভূষণ সম্মানে। কে বলেছে এদেশের মাটিতে প্রস্ফুটিত হয় না বাঙালি। কে বলেছে সম্মান লাভের তাগিদে দেশত্যাগী হতে হয় বাঙালিকে ? কে বলেছে শুধুমাত্র বিদেশের জল-হাওয়া-বাতাসেই মহীরূহ হয়ে ওঠে বাঙালি নামক এই বৃক্ষ? এই দেশের অর্থনীতিতে কৌশিকবাবুর ভূমিকা তো এখন প্রায় সকলেরই জানা--তা সে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নীতি নির্ধারণে সাহায্য করাই হোক বা বিশ্ববাজারে মন্দাবস্থা থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখাই হোক--কৌশিকবাবুর মতামতের কী গুরুত্ব কারোরই অজানা নয় । অশোক সেন, কৌশিক বসুর মতো আর একজন প্রথিতযশা বাঙালি দেবরাজ রায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শংকর তাঁর ভ্রমণ কাহিনী, "জানা দেশ অজানা কথা"--য় লিখেছিলেন, বিদেশের মাটিতে কোনও বাঙালি পা রাখলে, প্রথমেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করা: যাদবপুর না শিবপুর? অর্থাৎ ভাবটা এমন যেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিবপুরের স্নাতক ছাড়া আর কোনও বাঙালি বিদেশের মাটিতে পা রাখেননি। এই সব প্রশ্নকারীদের মুখে ছাই দিয়ে 1957 সালের 3 সেপ্টেম্বরে জন্ম দেবরাজ রায়ের পড়াশোনা এই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারপর 1981 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। 1983 সালে ডক্টরেট দেবরাজবাবু নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলিয়াস সিলভার অধ্যাপক এবং গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন ইকোনমিক্সের অধিকর্তা । নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থাকা দেবরাজবাবু প্রায়শই লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইটি, ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো শহরের ইনস্তিতিউতো নাশিওনাল ডি ম্যাটেমেটিকো পুরা-ই অ্যাপ্লিকাডা এবং চিনের বেজিং-এ পিপলস্ ইউনিভার্সিটি অব চায়নায় অর্থনীতির ছাত্র ছাত্রীদের পড়াতে যেতে হয় এখনও । আর স্পেনের বার্সিলোনায় ইনস্তিতিউতো ডি অ্যানালিসিসে তিনি গবেষক অ্যাফিলিয়েত। নরওয়ের ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট দেবরাজবাবু গিটনার সম্মান, মহালনবিশ স্মৃতি সম্মানে ভূষিত। বেশ কয়েক বছর বিখ্যাত ইকোনমেট্রিকা, জার্নাল অব ইকোনমিক থিওরি, জার্নাল অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স, আমেরিকার অর্থনীতির জার্নাল ম্যাক্রোইকোনমিক্সের সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য পক্ককেশী দেবরাজবাবুকে এক পলকে দেখলেও কিন্তু এখনও মনে হবে তিনি শতকরা একশো শতাংশ বাঙালিই আছেন। বহু বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেও ইংরেজি বলেন একেবারে ক্যুইন্স অ্যাকসেন্টে, আর পাঁচজন মার্কিনীদের মতো নন। সময় পেলেই চলে আসেন নিজের শহর কলকাতায়, আর পারলে দুগ্গোপুজোয় এখনও ঢাকের তালে নেচে ওঠেন। এত বছর প্রবাসে থাকার পরেও দেবরাজবাবু ষোলো আনার বদলে আঠারো আনা বাঙালি, যে বাঙালি কোনও অনুষ্ঠানে ধুতি পাঞ্জাবি পরতেই বেশি ভালবাসেন। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ঢাকা কলেজের স্নাতক। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করার পর পাড়ি দেন সুদূর রাশিয়ার রাজধানী মস্কো শহরে। সেখানকার পেকভ ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট দেবপ্রিয়বাবু চলে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যুইন এলিজাবেথ হাউজে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি করতে। পরে 2004-2005 সালে সিনিয়র ফুলব্রাইট ফেলো হিসেবে ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। বর্তমানে ইউনাইটেড নেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউ টেকনোলজি, মাসট্রিখট এবং গ্লাসগো স্ট্রাইথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিয়ে করেন রুশী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপিকা ইরিনা শেবানোভাকে। দেবপ্রিয়-শেবানোভার একমাত্র কন্যা সন্তান আলেকজান্দ্রা অবশ্য বাবা মায়ের মতো অর্থনীতিকে বেছে নেননি। তাঁর প্রথম পছন্দ আইনবিজ্ঞান। ভারতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে কৌশিক বসুর যে ভূমিকা, বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ঠিক একই ভূমিকা দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের । ইলিশ মাছের লংকা পোড়া ঝোল, চিতল মাছের মুইঠার ভক্ত পাবলিক পলিসি অ্যানালিস্ট দেবপ্রিয়বাবু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দায়িত্ব একরকম একার কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছেন। পরপর তিন বার বাংলাদেশের ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্যানেল অব অ্যাডভাইজরির অন্যতম সদস্য। এ ছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের টাস্ক ফোর্সের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর তার পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ-সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের পরিচালন কমিটির সদস্য হিসেবে। 2007 সালে বাংলাদেশের তদারকি সরকার জেনিভায় দেশের স্থায়ী সদস্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে পাঠায়। সেই সময় শুধু বাংলাদেশই নয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কথা বিশ্বের দরবারে একাধিকবার তুলে ধরেছেন বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ। 2008 সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ঢাকায় সরকার গঠন করলে তিনি ওই পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে ফিরে আবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগে যোগ দেন। বর্তমানে সিপিডিতে যুক্ত দেবপ্রিয়বাবুর প্রধান আগ্রহ বিশ্ব বাণিজ্য ও বৈদেশিক ঋণ। সেকালে বিদেশের মাটিতে প্রচন্ড অর্থ কষ্টে থাকা অমিত্রাক্ষর ছন্দের কারিগর মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দেশ থেকে অর্থ সাহায্য পাঠাতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কৃতি বাঙালিরা। আর এখন বাঙালিকে দেশ থেকে অর্থ সাহায্য পাঠাতে হয় না কাউকে। বরং প্রবাসী ওই বাঙালিরাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কাজে। ভারতের ইতিহাসকে উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা হয়তো কেউ দেখাবেন না। তাই মেনে নিতে অসুবিধা নেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যেমন সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করেছিল অবিভক্ত বাংলা আর পঞ্জাবের মানুষ, তেমনই আজও ওই বাঙালি জাতিই তাঁদের মেধা দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতির মাথা উঁচু রেখেছেন। বাঙালি কি সত্যিই বাঙালি হয়েই থাকতে চান, মানুষ হতে চান না ? নোবেল পুরস্কারে ভূষিত বরেণ্য অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, কিংবা পদার্থবিজ্ঞানী মণি ভৌমিকের কথা বাদই রাখলাম, রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী আশিস নন্দী, প্রয়াত পদার্থবিজ্ঞানী অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজবিজ্ঞানী গায়ত্রী ভট্টাচার্য স্পিভাক কিংবা নিউ জার্সির টাউন অব বার্লিংটনের অবসরপ্রাপ্ত অধিকর্তা, শ্যামলেন্দু নারায়ণ চৌধুরির কথাই ধরা যাক। দেশভাগের ঠিক পরেই বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে নিজেদের ভিটে মাটি ছেড়ে একরকম কর্পদকশূন্য হয়ে কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে চলে এসেছিলেন চিকিৎসক স্বর্গীয় পার্বতীনারায়ণ চৌধুরি ও তাঁর স্ত্রী লীলাবতী চৌধুরি। সঙ্গে ছয় পুত্রের চতুর্থ শ্যামলেন্দু নারায়ণ হিন্দু হাই স্কুল থেকে পাশ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তদানীন্তন সিএমপিও দফতরের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করতে পাড়ি দেন সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শ্যামলেন্দু বর্তমান পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ও পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সমসাময়িক । একসঙ্গে ছাত্র পরিষদের রাজনীতি করতেন ছাত্রাবস্থায় । তারপর নকশাল আমলে সত্তর দশকে একরকম ঘটি বাটি বিক্রি করে প্রাণের তাগিদে দেশত্যাগী হওয়া । কারিগরি ও স্থাপত্য বিদ্যার স্নাতক শ্যামলেন্দুবাবু সে দেশে চাকরি করতে করতেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে টেক্সাস, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি ও ম্যাসাচুসেটস প্রদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে প্রথম ভারতীয় হিসেবে টাউন অব বার্লিংটনের পূর্ত দফতরের অধিকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানই ভানে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেও সক্রিয় রাজনীতিতে হয়ে পড়েন। ডেমোক্র্যাট পার্টির সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে যুক্ত ছিলেন বহু বছর। ঢেলে সাজান টাউন অব বার্লিংটন। গড়ে তোলেন নতুন নতুন রাস্তা থেকে শুরু করে শীতে গরীবগুর্বোদের বাঁচার জন্য হিটিং সিস্টেম। পরোপকারী হিসেবে সকলের প্রিয় শ্যামলেন্দুবাবু বিবাহ করেন মার্কিন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিশিয়াকে। প্যাট্রিশিয়াও শ্যামলেন্দুবাবুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে পড়েন সমাজকল্যাণমূলক কাজে । কার বাড়িতে কর না দেওয়ার কারণে হিটিং সিস্টেম কাজ করছে না, কে শীতে কষ্ট পাচ্ছেন, কার বাড়ির সামনে জমে রয়েছে কয়েক ফুট বরফ, সব নিজে হাতে তদারকি করতেন তিনি। কোনও কিছুতেই কোনও ক্লান্তি নেই তাঁর । এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক শ্যামলেন্দুর এই পেশাগত ভালবাসা আকৃষ্ট করেনি আনন্দ আর অনামিকাকে। আনন্দ নিউ ইয়র্ক শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী আর অনামিকা এন্ডোক্রেনোলজিস্ট। বেশ কয়েকবার ব্রেন স্ট্রোক হওয়ায় চিকিৎসকদের নির্দেশে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। একটা সময় নিয়ম করে দেশে আসতেন শ্যামলেন্দু চৌধুরি ও তাঁর পরিবার। এখন শারীরিক কারণে আর আসা হয় না। আগে যখন আসতেন, নিজের পেনশনের একটা অংশ দান করতেন এই শহরের অনাথ শিশুদের পড়াশোনার জন্য । একটা কথা না বলে হয়তো এই লেখার সমাপ্তি টানা উচিত হবে না। এই আননোন বাঙালিরা কেউই নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটাননি কখনও । আগামীদিনেও পেটাবেন না। একেবারেই আড়ালে, নীরবে, নিজেকে প্রচারের আলো থেকে শতক যোজন দূরে রেখে কাজ করে চলেছেন। এই পৃথিবীতে কেউ-ই স্থায়ী নন, কারও জন্যই কিছু আটকে থাকে না--তাই কীই বা হবে মানুষের মাঝে নিজের ঢাক ঢোল পিটিয়ে? কিন্তু পাঠককূলেরও তো জানার অধিকার আছে, তাঁরা তো ক্লান্ত রাজনৈতিক কচকচানি আর সিনেমা জগতের বস্তা পচা গল্প শুনে। তাই মানুষের গল্প পৌঁছাক মানুষের দরবারে--যাঁরা আননোন বেঙ্গলিজ।